বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মানে শিক্ষা জাতীয়করণের অসমাপ্ত কাজ জননেত্রী শেখ হাসিনাকেই সমাপ্ত করতে হবে

অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু :একটি জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান সোপান সে দেশের শিক্ষা। যে জাতি শিক্ষাকে যতবেশি গুরুত্ব দিয়েছে সে জাতি ততবেশি উন্নতি হয়েছে। এই উপলব্ধি থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা উত্তোর যুদ্ধ বিধস্ত বাংলাদেশের শুন্য হাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় দায়িত্ব গ্রহণ করার পর শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭২-৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটেই দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ বছরে বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার। শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৬২ হাজার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন এক সাথে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্বে এরকম অন্যকোন নজীর খুঁজে পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুর পর তাঁরই কন্যা সফল রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় বিদ্যালয় জাতীয়করণের মাধ্যমে আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

বাংলাদেশে শিক্ষার প্রায় ৯৮% বেসরকারি ব্যবস্হাপনায় পরিচালিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়,কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজারের অধিক। এমপিওর বাইরে রয়েছে আরো প্রায় আট হাজার প্রতিষ্ঠান। ননএমপিও শিক্ষক কর্মচারীরা সরকার থেকে কোন বেতনই পান না। এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীরা যে বেতন পান তাও পর্যাপ্ত নয়। সরকারি বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের সামাজিক ও আর্থিক সুযোগ সুবিধায় রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। এই বৈষম্য বহাল রেখে দেশের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি থেকেই শিক্ষার এই বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ (স্বাশিপ)। আনুষ্ঠানিক ভাবে ২০১১ সালে স্বাশিপের যাত্রা শুরু হলেও অনানুষ্ঠানিক ভাবে আরো কয়েক বছর পুর্ব থেকেই কাজ করে যাচ্ছিল।

স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের মুল লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ। স্বাশিপ গতানুগতিক শিক্ষক আন্দোলনের বাইরে নতুন ধারার শিক্ষক আন্দোলনের সূচনা করে। স্বাশিপ বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার মাধ্যমে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক, সামাজিক, রাজনৈতিক,সুশিল সমাজের প্রতিনিধি, অভিবাবক সহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে জাতীয় স্বার্থে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার চেষ্টা করে । গত এক দশক যাবৎ স্বাশিপ সেই কাজটিই করে যাচ্ছে। স্বাশিপ মনে করে শিক্ষার জাতীয়করণ শুধু অর্থনৈতিক সক্ষমতার উপরই নির্ভর করে না, এজন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। স্বাশিপের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই শিক্ষার জাতীয়করণের লক্ষ্যে বিভিন্ন সভা,সমাবেশ,সেমিনার, সিম্পোজিয়াম,গোলটেবিল বৈঠক, মানববন্ধন,সংবাদ সম্মেলন, ইফতার পাটি,জেলা,উপজেলা সম্মেলন প্রভৃতি অনুষ্ঠানে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী,এমপি, শিক্ষাবিদ,সুশিল সমাজের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হয়। গত ১১/১২ বছরে শ্বাশিপের এসব বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকারের প্রায় সকল মন্ত্রী,এমপি,বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গকে উপস্থিত করা হয়। স্বাশিপের এই উদ্যোগের সুফলও আমরা পেয়েছি যেমন ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের সরকারি অনুরূপ জাতীয় বেতন স্কেলে শতভাগ বেতন,২০% মহার্ঘ ভাতা,৫% ইনক্রিমেন্ট,২০ % বৈশাখী ভাতা, কল্যাণ ট্রাষ্ট ও অবসর বোর্ডের জন্য ১ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ,নয়শত টাকা বাড়ী ভাড়া ও দুইশত টাকা মেডিকেল ভাতা বৃদ্ধি,শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষে এনটিআরসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রভৃতি।

এসব প্রাপ্তির ফলে সরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের সাথে বৈষম্য অনেকটা কমে এসেছে। বিশেষ করে জাতীয় স্কেলে ১০০% বেতন,৫% ইনক্রিমেন্ট,২০% বৈশাখী প্রাপ্তি একটি বড় অর্জন। এখন সরকারি বেসরকারিদের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য রয়েছে বাড়ি ভাড়া,মেডিকেল ও উৎসব ভাতার ক্ষেত্রে। এছাড়া এনটিআরসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ফলে এ ক্ষেত্রে কমিটি অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ হয়েছে। ফলে এখন সম্পুণ সচ্ছতার সাথে মেধাবী শিক্ষকরা নিয়োগ পাচ্ছেন। যা জাতীয়করণের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় বাধা অতিক্রম হলো। এসব বিবেচনায়,বিশেষ করে কোভিড-১৯ করোনা মহামারির ফলে শিক্ষার যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তার ভয়াবহ পরিণতির কথা বিবেচনা করে শিক্ষাকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করানোর জন্য শিক্ষার জাতীয়করণের যুক্তিকতা আবার নতুন করে সামনে এলো। তাছাড়া সযফল রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সকল ঘাত প্রতিঘাত,বাধা বিঘ্ন মোকাবেলা করে বাংলাদেশ যে অধম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে গতিকে অব্যাহত রাখতে এবং ভীশন ২০৪১,এসডিজি এবং ডেল্টা প্লান বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষা জাতীয়করণের কোন বিকল্প নেই।

তবে আসার কথা হলো আমাদের দীর্ঘ প্রচেষ্ঠার ফসল জাতীয় সংসদের গত বাজেট সেশনে বেশ কয়েকজন সম্মানিত সংসদ সদস্য ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও,বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের উৎসব ভাতা সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি উত্থাপন করেছেন। যে সকল সম্মানিত জাতীয় সংসদ সদস্যগণ শিক্ষার এই বাস্তবতা উপলব্ধি করায় স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ তথা এদেশের শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে তাদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। মনে রাখতে হবে শুধু শিক্ষকদের স্বার্থে নয় দেশের সর্বশ্রেণীর জনগণের শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং বিশ্ব উপযোগি শিক্ষা নিশ্চিত করতেই শিক্ষা জাতীয়করণ অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মানে তাঁরই সুকন্যা সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকেই শিক্ষা জাতীয়করণের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হবে।
(লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা,সাধারণ সম্পাদক,স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ।)