সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা, সরিয়ে দেয়ার দাবি

ঢাকা অফিস : স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ‘পজিটিভ’ খবর দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তা না হলে তরুণ, বয়স্ক, চিকিৎসকসহ তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা তুলে ধরেন। তাঁরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেন। কেউ কেউ মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ারও দাবি তোলেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, সাবেক-বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যাঁরই হোক, অসুখ হলে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। প্রধানমন্ত্রী, আপনি একটা নির্দেশনা দেন। এমপি, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করবেন। জরুরি প্রয়োজন না হলে বিদেশ যাবে না। তাহলে উন্নতি হবে।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে মুজিবুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ২৪ ঘণ্টা খবর রাখছেন। কিন্তু আপনার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তো একবার ঢাকা মেডিকেলে, একবার সোহরাওয়ার্দী, একবার জাতীয় হৃদ্‌রোগ হাসপাতালে কিংবা পিজিতে ভিজিট করা উচিত ছিল। আমি সেখানে এমনিতেই গেছি। ডাক্তাররা বলছেন, এখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এলে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সমালোচনা করে জাতীয় পার্টির এই সাংসদ বলেন, ‘৩ মার্চ স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক বললেন, বাংলাদেশের যে আর্দ্রতা, গরম, করোনা বাংলাদেশে আসতে আসতে মরে যাবে। কোনো সমস্যা হবে না। আবার ২৫ জুন সেই একই ব্যক্তি বললেন, করোনা দুই থেকে তিন বছরে যাবে না। এগুলো দেখা প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, থানা-উপজেলায় প্রথমে খুবই নিম্নমানের পিপিই দেওয়া হলো। তাঁর এলাকায় এগুলো পরে ডাক্তার-নার্স আক্রান্ত হলেন। যাঁরা আক্রান্ত হলেন, মারা গেলেন কে জবাব দেবে?

বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘করোনায় মারা যাবে। সারা পৃথিবীতে যাচ্ছে। কিন্তু কতটুকু চিকিৎসা দিতে পারছি, এটাই বড় প্রশ্ন? দেশে সেই চিকিৎসাটাই নেই।’ বাংলাদেশে সংক্রমণ হার অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নমুনা পরীক্ষার ২৩ শতাংশ পজিটিভ আসছে। তাও ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে ১০ থেকে ১৫ দিন পর। এতে ঝুঁকি আরও বাড়ছে।’ তিনি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বাড়ানোর দাবি জানান।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, বেসরকারি অনেক হাসপাতালে ডাক্তাররা ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। বেতন পান ২০ হাজার টাকা। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর লাগাম টানতে না পারলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা দাঁড় করানো যাবে না।

জাপার আরেক সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘৩৭ লাখ টাকার পর্দার কথা শুনেছি। ডাক্তারদের ২০ কোটি টাকার খাওয়ার বিল এসেছে। সেখানে একটি কলার দাম ২ হাজার টাকা। একটা ডিমের দাম এক হাজার টাকা। রুটির এক স্লাইসের দাম তিন হাজার টাকা। এ অবস্থা করোনাকালেও। কয়েক দিন আগে দেখেছি কিট কেনার দুর্নীতির কারণে জিম্বাবুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মানুষ বলছে, আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাকি মিনা কার্টুনে পরিণত হয়েছে। টিয়া পাখি দ্বারা চলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।’

সুনামগঞ্জে নিজ নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের বরাত দিয়ে পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘এই যে আইসিইউ, অক্সিজেন ও চিকিৎসা নেই। গ্রামের বাজারের লোকজন তাঁকে সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার কথা তোলার অনুরোধ করেছেন। গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব মতিয়া চৌধুরীর হাতে দেওয়ার কথা বলেছেন।’

সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, করোনার পর পৃথিবীতে অনেক কিছু হবে। সভ্যতার সংকট, নেতৃত্বের অদল–বদল হবে। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে থাকবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সচেতনতার অভ্যাসগুলো থেকে যাবে। তাই স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়ের নেওয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেন এবং নিজে মাঠে আছেন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় মিডিয়া বলে, আমরা এখন ঘরে বসে আছি। মিডিয়া যদি সব সময় শুধু মৃত্যুর খবর, দুঃসংবাদ দিতে থাকে, তাহলে আমাদের যারা তরুণ জেনারেশন আছে, তারা কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে। আমাদের বয়স্করাও অসুস্থ হয়ে যাবে। আমরাও যারা আছি, তারাও অসুস্থ হয়ে যাব। তাই আমাদের একটু পজিটিভলি কথা বলতে হবে।’

নিজের ভূমিকার সপক্ষে বলতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পাঁচ মাস কিন্তু আমরাই মাঠে আছি। প্রতিটি হাসপাতাল যে আমরা যাইনি, এ কথাটা সঠিক নয়। বসুন্ধরা কীভাবে বানিয়েছি। ২৫ দিনে বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টার, হাসপাতাল করা হয়েছে। যেখানে দুই হাজার বেড আছে। যতগুলো কোভিড সেন্টার রয়েছে, সব কটি উদ্বোধন করেছি। ডাক্তার-নার্স আমরা যারা কাজ করি, তাদের অনুপ্রাণিত করলে তারা আরও কাজ ভালো করবে। ৫০ জন ডাক্তার-নার্স মারা গেছেন। সব সময়ই যদি সমালোচনা করি, তাহলে সঠিক হবে না।’

সফটওয়্যার ক্রয়ে দুর্নীতি ও ডাক্তারদের থাকা-খাওয়ার জন্য অস্বাভাবিক ব্যয়ের ব্যাখ্যা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, সফটওয়্যার ক্রয় হয়নি। এটা প্রাক্কলন। বিশ্বব্যাংকের টাকা। তারাই ক্রয় করবে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের যেটা আমি খবর নিলাম। ৫০টি হোটেল ভাড়া নেওয়া হয়েছে। ৩ হাজার ৭০০ লোক এক মাস থেকেছেন। হিসাব করে বের করেছি, ১ হাজার ১০০ টাকায় প্রতিটি কক্ষ ভাড়া হয়েছে। খাওয়ার খরচ যেটা বললেন, এটা ঠিক নয়। ৫০০ টাকা তিনটি মিলের জন্য। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও ডিনার মিলে ৫০০ টাকা। যে হিসাবটি দিলেন, পুরোপুরি ভুল।’

করোনায় সাফল্য আছে দাবি করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘করোনায় সোয়া লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে। দোকানপাট চালু হয়েছে। জীবন-জীবিকার বিষয় আছে। শিল্পকারখানা চালু হয়েছে। ঈদে আমরা বাড়ি যাই। এ জন্য সংক্রমণের হার একটু বেড়েছে। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা তো কম। আমরা আশা করি, এই সংক্রমণ হারও কমবে, যখন মানুষ বেশি করে মাস্ক পরবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় চলবে এবং মানুষ জানবে যে কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত করা যায়। এই বিষয়গুলো আগে জানত না। এখন জানে।’

বর্তমানে সরকারের স্বাস্থ্য খাতে অবদান তুলে ধরে জাহিদ মালেক বলেন, শেখ হাসিনার সরকার ক্যানসার ইনস্টিটিউট, চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮টি মেডিকেল কলেজ ও আড়াই শ নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। হাসপাতালে ২৫ হাজার শয্যা বাড়ানো হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ভ্যাকসিন হিরো হয়েছেন। মাদার অব হিউম্যানিটি, সাউথ সাউথ পুরস্কার পেয়েছেন। সব স্বাস্থ্যের কারণে হয়েছেন। আমাদের এখন গড় আয়ু ৭৩ বছর। আর অল্প দিন হলেই এটা আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে ধরে ফেলব। তাদের এখন গড় আয়ু ৭৮ বছর। কাজেই এটা স্বাস্থ্যের একটা বড় অবদান।’

সবার সহযোগিতা পেলে অল্প দিনের মধ্যেই কোভিড-১৯ থেকে ছাড় পাওয়া যাবে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, ‘কোভিড চলে গেলে সাধারণ গতিতে এগিয়ে যাবে দেশ। প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ৮.২, যেটা ধরা আছে তা পারব। তবে কোভিড ভাইরাস যদি না যায়, যদি আমরা সব সময় মৃত্যুর ঝুঁকিতে, ভয়ে থাকি, তাহলে কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ভালো হবে না।’
ভিন্নবার্তা ডটকম/এসএস