ভিসেরায় মেলেনি বিষক্রিয়া অতিরিক্ত আঘাতেই মৃত্যু

সিলেট প্রতিনিধি: সিলেটে পুলিশের নির্যাতনের শিকার রায়হান আহমদ কোনো বিষক্রিয়ায় মারা যাননি। তার মৃত্যু একটি হত্যাকাণ্ড। রায়হানের প্রথম ভিসেরা প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে। রোববার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে ভিসেরা প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করেন ওসমানী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সামসুল ইসলাম।

নগরীর আখালিয়া বাসিন্দা রায়হানকে (৩৪) এ বছরের ১০ অক্টোবর রাতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে পুলিশ প্রচণ্ড নির্যাতন করে। ১১ অক্টোবর সকালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার সাব ইন্সপেক্টর (বরখাস্ত) এসআই আবদুল বাতেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি ছাড়াই লাশের সুরতহাল তৈরি করেন। এদিকে ওইদিন রাতেই রায়হানের স্ত্রী তামান্না আক্তার হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন। আদালত মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দেন। এরপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ১৫ অক্টোবর রায়হানের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করা হয়। একইদিন ওসমানী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ রায়হানের প্রথম ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদন দেয়।

এতে রায়হানের শরীরে ১১৪টি আঘাতের চিহ্ন এবং অতিরিক্ত আঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রথম ময়নাতদন্তের ভিসেরা নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। সেই নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ভিসেরা প্রতিবেদন ওসমানী মেডিকেল কলেজে পৌঁছায়। এরপর তা রোববার পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এ বিষয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সামসুল ইসলাম জানান, ভিসেরা নমুনায় কোনো ধরনের বিষক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এটা একটি হত্যাকাণ্ড বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল অতিরিক্ত আঘাতেই রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। এটা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভিসেরা নমুনা পাঠানো হয়। ভিসেরা প্রতিবেদনেও বিষয়টি নিশ্চিত হল- রায়হানের মৃত্যু অতিরিক্ত আঘাতের কারণেই হয়েছে।

প্রতিবেদন হাতে পেয়ে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খালেদ উজ জামান গণমাধ্যমকে জানান, প্রথম ভিসেরা প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। এতে রায়হান মৃত্যুর ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা প্রথম ময়নাতদন্তের ভিসেরা প্রতিবেদন হলেও বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন হিসেবে এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের ভিসেরা প্রতিবেদনও গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি জানান।

প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- রায়হানের শরীরে ১১৪টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পিঠ, দুই থাই, দুই হাঁটুর জয়েন্ট, দুই কবজির জয়েন্ট, পায়ের গোড়ালি, পায়ের পাতা, দুই বাহুর চার পাশে ৯৭টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৬টি আঘাত গুরুতর জখম তৈরি করে। বিশেষ করে দুই হাতের কবজিতে চারটি, ডান পায়ের সামনের দিকে দুটি, পেছনের দিকে তিনটি, বাম পায়ের সামনের দিকে দুটি, ডান পায়ের গোড়ালিতে তিনটি গুরুতর জখম হয়। এতে আরও বলা হয়, ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল আর বাম হাতের অনামিকার নখ উপড়ানো পাওয়া যায়। নির্যাতনের ফলে অসংখ্য আঘাতে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোয় রায়হানের মৃত্যু হয়েছে।

রায়হান হত্যা এবং ঘটনার পর এসআই (বরখাস্ত) আকবর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় এসএমপি ও পুলিশ সদর দফতর দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রাথমিক তদন্তে রায়হানের হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বন্দর ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন, কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া, টিটু চন্দ্র দাশ ও হারুনুর রশীদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আর বন্দর বাজারফাঁড়ি থেকে এএসআই আশেক এলাহী, কুতুব আলী, কনস্টেবল সজীব হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়। এর মধ্যে এসআই আকবর হোসেন পালিয়ে গেলেও বাকি ছয়জনকে পুলিশ লাইনে কড়া নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়া হয়।

১৩ অক্টোবর পিবিআইয়ের কাছে রায়হান হত্যা মামলার তদন্ত ভার দেয়া হয়। ঘটনার দিন পুলিশ ফাঁড়িতে দায়িত্বে থাকা তিন পুলিশ সদস্য ১৯ অক্টোবর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এরপর কনস্টেবল টিটু চন্দ্র ও কনস্টেবল হারুনুর রশিদকে গ্রেফতার করে দুই দফায় আট দিন করে এবং এএসআই আশেক এলাহীকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। সবশেষ ৯ নভেম্বর রায়হান হত্যা মামলার প্রধান আসামি এসআই (বরখাস্ত) আকবরকে কানাইঘাটের সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করে সিলেট জেলা পুলিশ।

তদন্ত শেষে এসএমপি কমিশনারসহ ৯ জনের দায়িত্বে অবহেলা খুঁজে পায় পুলিশ সদর দফতর। এর মধ্যে কোতোয়ালি থানায় ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৌমেন মৈত্রী, মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আবদুল বাতেন ও বন্দরফাঁড়ির এএসআই কুতুব আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আলামত নষ্টের দায়ে এসআই হাসানকে বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া পুলিশ কমিশনারসহ আরও পাঁচ কর্মকর্তাকে শাস্তির সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফদর।

রায়হানের হত্যাকারী পুলিশ সদস্যদের ফাঁসির দাবিতে রায়হানের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন এবং স্থানীয়রা মানববন্ধনসহ কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ করেন। হত্যাকারীদের শাস্তির আওতায় আনা না হলে কঠোর আন্দোলনেরও কর্মসূচি দেয়া হয়।