বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও বাংলাদেশের শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গ

অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু : পাঁচ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বিশ্বের সকল স্তরের শিক্ষকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রাণঢালা অভিনন্দন। ১৯৬৬ সালে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষে ইউনেস্কো, আইএলও বিশ্ব শিক্ষক দিবসের সূচনা করেছিল। দিবসটির সূচনার অর্ধশত বছের পরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার জন্য আজো আন্দোলন অব্যাহত আছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৮% এবং সর্বশেষ ডাকারে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষা মন্ত্রীদের সভায় আপাতত জিডিপির ৬% বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই ইউনেস্কো ঘোষিত সেই সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ সরকারও এই সিদ্ধান্তে স্বাক্ষরকারি দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে জিডিপির ২.৪-২.৫% এর বেশি বরাদ্দ সরকার দিতে পারেনি।

বাংলাদেশে শিক্ষকদের অধিকার,মর্যাদা এবং শিক্ষা আন্দোলনের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। দুই শত বছরের বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং তেইশ বছরের পাকিস্তানি শোষণ, নিপীড়ন ও শিক্ষা সংকোচন নীতি বাঙালি জাতিকে শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে রেখেছিল। ফলে শিক্ষার সকল ক্ষেত্রে অন্তহীন সমস্যা বিরাজমান ছিল। ১৯৪৪ সালের পুর্বে এদেশে শিক্ষকদের কোন বেতন ভাতা ছিল না। ১৯৪৪ সালে শিক্ষকদের আন্দোলনে মাধ্যমিক শিক্ষকদের পাঁচ টাকা মহার্ঘ্য ভাতা চালু হয়। শিক্ষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৫৮ সালে সেই ভাতা বৃদ্ধি করে পনের টাকা এবং ১৯৭০ সালে ত্রিশ টাকা করা হয়।

বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে একাত্তরে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হয়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় দায়িত্ব নেওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু প্রথম বাজেটেই শিক্ষা জাতীয়করনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধবিদ্ধস্হ নবসৃষ্ট বাংলাদেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে (৩৬ হাজার) জাতীয়করণের মাধ্যমে এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছিলেন। তিনি প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডক্টর কুরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন গঠনের মাধ্যমে এদেশে একটি বৈষম্যহীন আধুনিক বিশ্বের উপযোগি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পচাত্তরের পনের আগস্টের মর্মান্তিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শিক্ষানীতি আর আলোর মুখ দেখেনি। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী শিক্ষা নীতি না পাওয়ার ফলে শিক্ষার সংকট দিনে দিনে বাড়তে থাকে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই মাধ্যমিক শিক্ষকরা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নামে। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের দাবিতে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠে। এ দফায় ৬৩ দিন ধর্মঘট পালিত হয়। সেই আন্দোলনে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি,রেশনিং চালু সহ বেশ কিছু দাবি পুরণ হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এটাই প্রথম শিক্ষক আন্দোলন।

সত্তোরের দশকের মাঝামাঝি জিয়াউর রহমানের শাসনামলেও শিক্ষকরা তাদের অধিকার আদায়ে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। ১৯৭৭ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয় স্কেলে বেতনের দাবিতে তখন রাজপথে নামেন শিক্ষকরা। বিভিন্ন দাবিতে ঘর্মঘট চলাকালে সচিবালয়ে শিক্ষা সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দাবি দাওয়া নিয়ে সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে শিক্ষক নেতৃবৃন্দের মতবিরোধ দেখা। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্দেশে একজন মেজর সভাস্হলে ঢুকে নামমাত্র সুবিধা দিয়ে জোর পুর্বক শিক্ষক নেতৃন্দের নিকট থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। এই সভায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান,ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক,শেখ আমান উল্লাহ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭৯ সালে শিক্ষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রী শাহ আজিজ শিক্ষকদের দাবি দাওয়া প্রসঙ্গে আপত্তিজনক মন্তব্য করলে শিক্ষকদের মধ্যে চরম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আন্দোলন চলাকালে সমঝোতা সভায় প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ বলেন “শিক্ষকরা অবৈধ দাবি করে রাজকোষ শুন্য করতে চাইছেন। এর বিরুদ্ধে তাঁর সরকার রেডিও টিভিতে প্রচার করে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করবে”। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের সম্পর্কে এরূপ অমর্যাকর বক্তব্যে শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়ে উঠে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৭৯ সালের ১১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সাথে এক সমঝোতা বৈঠকে বসেন। উক্ত বৈঠকে ১৯৮০ এবং ১৯৮১ সালের মধ্যে জাতীয় বেতন স্কেলে ৫০% বেতন কার্যকর করার বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১৯৮২ সালে সামরিক স্বৈরশাসক হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর তিনি শিক্ষকদের একটি অংশকে হাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ঐ বছরের ১৬ জুলাই তিনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী অত্যন্ত চতুর মাওলানা মান্নানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দকে তার দফতরে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) আমন্ত্রণ জানান। সেই সভায় তিনি সরকারি চাকরিজীবিদের অনুরূপ বেসরকারি শিক্ষকদেরকেও ৩০% মহার্ঘ ভাতা প্রদানের ঘোষনা করেন। সেই সাথে তিনি নিজ থেকেই শিক্ষক নেতা হওয়ার ইচ্ছা পোষন করে উপস্হিত নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে বলেন-“আপনাদের তো বহু সমস্যা। সেগুলো সমাধানের জন্য আমার কাছেই আসতে হবে। আমি যদি সেগুলো সমাধানের ভার নিই-আমি যদি কাজের সুবিধার জন্য ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হই,আপনাদের কোন আপত্তি আছে”? তার এই প্রস্তাবে কেউ আর বিরোধিতা করতে সাহস পাননি। ফলে রাষ্ট্রপতি এরশাদকে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি করা হয়।

এরশাদ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি হলেও অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে শিক্ষকদের প্রগতিশীল অংশ তাদের মত করে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ সহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৮৬ সালে সারাদেশে শিক্ষক ধর্মঘট পালিত হয়। শিক্ষকরা সেই সময় দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষা বয়কট করেন। এরশাদ সরকার নিরুপায় হয়ে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ও সরকারি কর্মচারীদের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন করে। আন্দোলন চলাকালে ১৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান ও হেনা দাস এবং ঢাকায় ২৯ জন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়। শিক্ষকদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে সরকার শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ১০% বৃদ্ধি করে ৫০% থেকে ৬০% করা হয়।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই শিক্ষকদের আন্দোলন আরো বেগবান হয়। বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষকদের ধর্মঘট চলাকালে ১৫ ফেব্রুয়ারি,১৯৯২ ইং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ধর্মঘটী শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন। তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেন “দেশে অনেক বেকার লোক আছে। বিকল্প ব্যবস্থায় প্রয়োজনে তাদের দিয়ে কাজ করানো হবে”। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্যে এরূপ হুমকির প্রতিবাদে সারাদের শিক্ষকরা চরম বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন। এ পর্যায়ে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। আন্দোলনের
ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে ১২ জুন থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে হাজার হাজার শিক্ষকের এক সপ্তাহব্যাপী অবস্থান ধর্মঘট পালিত হয়। অবস্হা বেগতিক দেখে সরকার শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সাথে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সমঝোতা বৈঠকে শিক্ষকদের বেতন ৭০% থেকে ৮০ %, একটা টাইম স্কেল,চিকিৎসা ভাতা একশ টাকা থেকে দেড়শ টাকা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৯৬ সালে নির্বাচনে সুদীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা সরকার শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষে গঠিত হয় সামসুল হক শিক্ষা কমিশন। শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই ১৯৯৭ সালে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট পুনরায় চালু করা হয়। এ সময়ই কোন প্রকার আন্দোলন ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় পে-স্কেলে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীরা অন্তর্ভুক্ত এবং শিক্ষকদের যার যার নামে ইনডেক্স সিস্টম চালু করে তাদের একাউন্টে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৭ সালে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে ৩৮ দিন শিক্ষক ধর্মঘট পালিত হয়। এক পর্যায়ে সরকার শিক্ষকদের বেতন ১০% বৃদ্ধি করে ৯০% এ উন্নীত করে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও শিক্ষক আন্দোলন বেশ জোড়ালো ছিল। বিশেষ করে ২০০৬ সালে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি সহ বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলে শতভাগে উন্নীত এবং বাড়ি ভাড়া চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে সারাদেশে শিক্ষক ধর্মঘট চলাকালে ১৬ জুলাই শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের শান্তিপুর্ণ মিছিলে পুলিশী নগ্ন হামলা চালায়। ৪০ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রী ওসমান ফারুক তার সরকারি বাসভবনে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকেই বেতন স্কেল ৯০% থেকে বাড়িয়ে ১০০% এ উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহবায়ক সর্বজনাব প্রয়াত শিক্ষক নেতা ডক্টর ম.আক্তারুজ্জামান,অধ্যক্ষ এম এ আউয়াল সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু ও প্রদীপ চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন । অবশ্য বেতন বৃদ্ধির আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি দেওয়া হয় বিএনপি সমর্থিত শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের সমাবেশে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে সচিবালয়ের সামনে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের শান্তিপুর্ণ মিছিলে পুলিশ বর্বর হামলা চালায়। হামলায় অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু ও মনি হালদার সহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক রক্তাক্ত আহত হন। সেই ক্ষতচিহ্ন এখনো তারা বয়ে বেড়াচ্ছেন।

সময়ের বিবর্তনে দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের গতি প্রকৃতিও পরিবর্তন হয়েছে। এখন মানুষ রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে জ্বালাও পোড়াও হরতাল অবরোধ পছন্দ না করার প্রভাব শিক্ষক আন্দোলনেও পড়েছে। এছাড়া শিক্ষকদের বেতন সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের চিন্তা চেতনারও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। পুর্বেকার বর্ষিয়ান শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সততা,মেধা,ব্যক্তিত্ব,আচার আচরণ, সাংঠনিক প্রজ্ঞা,দূরদৃষ্টি সাধারণ শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতো । এসকল নেতাদের দেশের প্রতি, পেশার প্রতি একটা কমিটমেন্ট ছিল। তাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও পারবারিক ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু বর্তমান শিক্ষক নেতাদের মেধা,প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা,দূরদৃষ্টি সাধারণ শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না বলে অনেকেই মনে করেন। তাছাড়া শিক্ষক সংগঠন গুলি বহুদা বিভক্তি। একে অপরের প্রতি অশ্রদ্ধা,অসম্মান বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রাতারাতি সংগঠন গড়ে তোলে দাবি আদায়ের নামে অপরিপক্ব কর্মসূচি প্রদান,একে অপরের প্রতি অশ্রদ্ধা,কাদা ছুড়াছুড়ি, এসব বিভিন্ন কারণে শিক্ষক রাজনীতি ও শিক্ষক আন্দোলন আজ তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে গত এক দশকে তেমন কোন শিক্ষক আন্দোলন গড়ে উঠেনি। ননএমপিওদের এমপিও এবং শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের প্রেসক্লাব কেন্দ্রিক সভা সমাবেশ এবং কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে বর্তমান সরকারের শাসনামলে শিক্ষানীতি প্রণয়ন,২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়,৩৩০ কলেজ,২২০ স্কুল জাতীয়করণ, জাতীয় বেতন স্কেলে শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ বৃদ্ধি, ৫% ইনক্রিমেন্ট,২০% বৈশাখী ভতা, কল্যাণ ও অবসর বোর্ডের জন্য ১৬৭৭ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও একসময় বেসরকারি শিক্ষকরা নামমাত্র বেতন পেতেন। সারা জীবন শিক্ষকতা করেও শেষ জীবনে তাদের শুন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হতো। অবসরকালিন কোন আর্থিক সুবিধা পেতেন না। এখন সময় বদলেছে। এখন বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরকালিন সময়ে সম্মানজনক কল্যাণ ও অবসর সুবিধা পাচ্ছেন। এসব কারণেও শিক্ষক আন্দোলন জোরদার গড়ে তোলা যায়নি।

তথাপিও বেসরকারি শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো অনেক বৈষম্য বিরাজমান। এখনো বিপুল সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও এমপিও বহির্ভূত থাকায় সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিপুল সংখ্যক শিক্ষক কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ছাড়াও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক বৈষম্যে বিরাজমান। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপ,শিক্ষকদের চাকরির নিশ্চয়তা ও মর্যাদার ক্ষেত্রেও বহু সমস্যা বিরাজমান রয়েছে। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজমান ক্ষোভ থেকে শিক্ষক আন্দোলন যে কোন সময় দানা বেধে উঠতে পারে। এসব সমস্যার সমাধান,শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দের কোন বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে একটি রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষার চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোন বিনিয়োগ হতে পারে না।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, সাধারণ সম্পাদক স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, ফাস্ট সেক্রেটারী ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব টিচার্স ইউনিয়ন (WFTU)।
শীর্ষবাণী/এনএ