‘আল্লাহর নিআমতরাজি নিয়ে গবেষণা করো; আল্লাহকে নিয়ে নয়’

ড. মোহাম্মদ অলী উল্যাহ : একটি দুর্বল মারফূ’ হাদীস ও হাসান পর্যায়ের মাওকূফ হাদীসের ভাষ্যমতে আল্লাহর জাত বা সত্ত্বা নিয়ে গবেষণা করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং তাঁর সৃষ্টি ও নিআমতরাজি নিয়ে গবেষণা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। (সিলসিলায়ে সহীহা লিল আলবানী) আল্লাহর আকার কেমন, তাঁর গুণবাচক নামসমূহ, যেমন সামী’ তথা শ্রবণশক্তিসম্পন্ন বা বাসীর তথা দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন হওয়া, তাঁর হাত, পা, হাসি-খুশী হওয়া বা রাগান্বিত হওয়া কেমন হবে ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করা একটি বাহুল্য ও বিপজ্জনক কাজ। এগুলোই ইলমুল কালামের বিষয়বস্তু। ইলমুত তাওহীদকে ইলমুল কালামে রূপান্তরিত করে এই বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলার গুণবাচক নামসমূহ ও তাঁর হাত, পা থাকা, হাসি-খুশী হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা ‘ইসতিওয়া’ বিষয়ে ইমাম মালেকের (র) দেয়া ব্যাখ্যার মধ্যে নিহিত।

তিনি বলেছেন, ইসতিওয়া বা কোন কিছুর উপর চড়ার অর্থ জ্ঞাত, ধরণ অজ্ঞাত, এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং প্রশ্ন করা বিদআত। অর্থাৎ এগুলো কুরআন-সুন্নায় যেভাবে এসেছে সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে; বাড়াবাড়ি করা যাবে না। এই জন্য ইলমুল কালামের দুই দিকপাল ইমাম জুআইনি (১০২৮-১০৮৫ খ্রি.) ও ইমাম রাযী (১১৪৯-১২১০ খ্রি.) মৃত্যুর সময় আফসোস করে বলেছিলেন, হায়! যদি নিশাপুরের বৃদ্ধা মহিলার আক্বীদার উপর মরতে পারতাম কতইনা ভাল হতো! নিশাপুরের বৃদ্ধা মহিলার আক্বীদা তথা কোন ঘাটাঘাটি না করে আল্লাহর প্রকৃতি সম্পর্কে যা যেভাবে আছে তা সেভাবে ফিতরী বা স্বভাবজাত জ্ঞানে বিশ্বাস করা।

একবার ইমাম রাযী তাঁর ছাত্রদের মাঝ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন তখন এক বৃদ্ধা জানতে চাইলো উনি কে? ছাত্ররা উত্তর করল, উনি হলেন ইলমুল কালামের বড় ইমাম, আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণেরর জন্য তিনি ১০০০ দলীল ঠিক করে রেখেছেন। শুনে বিস্ময়ের সাথে মহিলা বলল, আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণেরর জন্যও কী কোন দলীল প্রয়োজন আছে?! উনার মনে হয় ১০০০ সন্দেহ আছে তাই তিনি ১০০০ দলীল ঠিক করে রেখেছেন। সুবহানআল্লাহ! কী দৃঢ় ঈমান। আমাদের দেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে আলীয়া কিংবা ক্বওমী শিক্ষা উভয় ধারাতেই আক্বীদা বিষয়ক যেসব কারিকুলাম রয়েছে তা কিছুটা ইলমুল কালাম দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষত আক্বায়েদে নসফী, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে বাইদাভী ইত্যাদি গ্রন্থসমূহ ইলমুল কালাম বা আশআরী-মাতুরিদী আক্বীদার উত্তরাধিকার বহন করে যেখানে আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামসমূহের তাবীল করা হয়েছে এ ধারণা থেকে যে, না হলে তা সৃষ্টির বিশেষণের সাথে মিলে যাবে।

মজার বিষয় হলো তারা ফিকহে হানাফীর অনুসারী হলেও আক্বীদার উপরোক্ত বিষয়টিতে ইমাম আবু হানিফা র. ও হানাফী ব্যারিস্টার খ্যাত ইমাম তাহাবীর মত অনুসরণ করছেন না। আমাদের দেশ তথা উপমহাদেশের ৭০% থেকে ৮০% ভাগ মুসলমানই কুরআন-হাদীসের জ্ঞান রাখে না। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি কিছু সূরা-ক্বিরআত, মাসআলা-মাসায়েল জেনে আল্লাহর ইবাদত করে। আল্লাহ এবং রাসূলের (স.) প্রতি তাদের মহব্বতও কম নয়। তারা কুরআন-হাদিস থেকে আল্লাহর বিশেষণসমূহ না শিখলেও স্বভাবজাত জ্ঞান দিয়েই তারা একে অপরের সাথে কথা বলাবলির সময় বলে, কেউ না দেখলেও আল্লাহ দেখছেন, কেউ না শুনলেও আল্লাহ শুনছেন, অমুক কাজ করলে আল্লাহ খুশী হবেন, অমুক কাজ করলে আল্লাহ বেজার হবেন ইত্যাদি। এটাই ফিতরী জ্ঞান যা উপরে বর্ণিত নিশাপুরের বৃদ্ধাদের আক্বীদা বা বিশ্বাস। এখন প্রশ্ন হলো উপরোক্ত তাবীলের কারণে তারা আহলে সুন্নাতের বাইরে চলে যাবে কি না?

এ বিষয়ে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া র. বলেছেন, ব্যাপক অর্থে তারা আহলে সুন্নাতের বাইরে নয়। কেননা যারা আবুবকর, উমর ও উসমানের (রা.) খিলাফত স্বীকার করে তারাই আহলে সুন্নাত; বাকীরা শীআ। আর বিশেষ অর্থে তারা যে যে বিষয়গুলো তাবীল করে সেগুলোতে আহলে সুন্নাতের সাথে তারা ভিন্নমত পোষণ করেছেন মর্মে বিবেচনা করা হবে। এটিই আধুনিক কালের দু’জন বিখ্যাত আলিম ইবনে বায ও ইবনে উছায়মিনের (র.) মত। উল্লেখ্য যে, ইমাম নববী, হাফিজ ইবনে হাজার আসক্বালানী প্রমুখ প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণও কিছু কিছু বিষয়ে তাবীলের প্রবক্তা। শেষ কথা হলো আমরা যদি উপরোক্ত আক্বীদা বৃহত্তর পরিসরে সংশোধনের চিন্তা করি তাহলে বড় আলিমদের সাথে বসতে হবে এবং কারিকুলাম সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। আর যদি ক্ষুদ্র পরিসরে চিন্তা করি তাহলে নিজস্ব আক্বীদার ক্লাসে বা আক্বীদা বিষয়ক গবেষকদের দিয়ে কাজ করাতে হবে। কিন্তু তা না করে পাবলিক প্লেস তথা ফেসবুক, ইউটিউব বা টেলিভিশনে এগুলো নিয়ে ইমাম মালেকের মত সংক্ষিপ্ত দিক নির্দেশনার বিপরীতে যদি বিস্তারিত আলোচনায় জড়িয়ে যাই তাহলে কুরআন-হাদীস না জানা বা স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন সাধারণ মানুষ ঈমান দৃঢ় করার পরিবর্তে বিভ্রান্তি ও সংশয়ে নিমজ্জিত হওয়ার শংকা থেকে যায়। কারণ বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর এবং ফলাফল হয় ঈমান পোক্ত হওয়া নতুবা ধ্বংস হওয়া। ফলে আম ও ছালা দুটোই খোয়া যাওয়ার ভয় থাকবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকল দাঈকে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বুঝার তাওফীক দিন। আমীন!!

লেখক : ড. মোহাম্মদ অলী উল্যাহ
অধ্যাপক, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, কুষ্টিয়া।